প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ( বর্ধমান ) : পণ্ডিত মশাই সঠিক ভাবেই পুজো করাচ্ছিলেন। কিন্তু আকন্ঠ কারণ সুধা পান করে পুজো করতে বসে পূর্ব পুরুষ বলে যাচ্ছিলেন বামে গনেশায় নমঃ, দক্ষিণে কার্তিকেয় নমঃ। পণ্ডিত মশাই প্রতিবাদ করলে বাস্তবেই দুর্গা প্রতিমায় গনেশ ও কার্তিকের এমনই স্থানবদল পণ্ডিত মশাই সহ সবাইকে চাক্ষুষ করিয়ে ছিলেন ওই তন্ত্রসাধক পূর্ব পুরুষ। সেই থেকে ৩০০ বছরেরও বেশী সময়কাল ধরে বামে গনেশ ও দক্ষিণে কার্তিককে অধিষ্ঠিত রেখে পূর্ব বর্ধমানের জামলপুরের সাদিপুর গ্রামের সভাকর বাড়িতে তৈরি হয় দুর্গা প্রতিমা। দেবী পক্ষে তন্ত্রমতে হয় সেই প্রতিমারই পুজো পাঠ। সভাকর বাড়ির এই পুজো ঘিরেই দুর্গোৎসবের কটা দিন মাতোয়ারা থাকেন সাদিপুর গ্রামের বাসিন্দারা। দামোদর লাগোয়া জামালপুরের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম সাদিপুর। সনাতন ঐতিহ্য মেনে এই গ্রামের সভাকর বাড়ির সাবেকি মন্দিরে হয় দেবীর আরাধনা। সভাকর পরিবারের বর্তমান বংশধর দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁদের পূর্ব পুরুষ হলেন, বল্লাল সেন, লক্ষণ সেনের আমলের লোক। বর্গীদের অত্যাচারে নিজভূমি ছেড়ে পূর্ব পুরুষরা পালিয়ে চলে আসেন সাদিপুর গ্রামে। সেখানেই তারা বসবাস শুরু করেন। দেবাশীষ বাবু আরও জানান, তাঁদের বংশের আদি অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালি। বংশে কালি পুজোর সূচনা কাল আরও বহু প্রাচীন। তবুও মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তাঁদের বংশের পূর্ব-পুরুষ উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় কালি বেদিতেই দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। হতদরিদ্র সাধক ব্রাহ্মণ উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় পুকুরের জল, বনের ফুল, চালতার আচার আর থোড়ের নৈবেদ্য দিয়ে দুর্গা মায়ের পুজো করতেন। সেই রীতি মেনে বাংলার ১১১১ সাল থেকে আজও একই ধারায় তাঁরা বর্তমান বংশধররা পুজো করে আসছেন। সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজোর অনেক কাহিনী আজও বংশের লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কথিত আছে, বহুকাল পূর্বে বন্যার সময়ে দামোদরে পাটাতন সহ দুর্গা প্রতিমার একটি কাঠামো ভেসে আসে। স্থানীয় নাগড়া গ্রামের বর্গক্ষত্রিয় ধারা পরিবারের কয়েজন সদস্য দামোদর থেকে সেই কাঠামোটি তুলে আনেন। তারা প্রতিমা কাঠামোর সেই কাঠামোটি দেবীপুরে বিক্রী করতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তারা ওই কাঠামো আর দেবীপুরে বিক্রি করতে যান নি, দেবীর নির্দেশ মেনে তারা পাটাতন সহ ওই কাঠামোটি হতদরিদ্র সভাকর পরিবারের বিধবা বধূ রতনমণি দেবীকে দিয়ে দেন। সেই পাটাতন ও প্রতিমা তৈরির কাঠামোতেই আজও দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে সভাকর বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে। কৃতজ্ঞতা স্বরুপ সেই সময়কাল থেকে প্রতিবছর দুর্গা পুজোর সময়ে নাগড়ার বর্গক্ষত্রীয় ওই ধারা পরিবারে নৈবেদ্য পাঠান সভাকর পরিবারের সদস্যরা। আরও কথিত আছে, পূর্ব পুরুষ উমাচরণ বাবুর সময়কালে একদল ডাকাত এক রাতের মধ্যে কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই সময়কার কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার মন্দিরটি আর এখন নেই। সভাকর বংশের বংশধররা পরবর্তীকালে ওই একই জায়গায় একটি সুন্দর পাকা দালান মন্দির তৈরি করেন। পুজোর সূচনার ইতিহাস যেমন বৈচিত্রে ভরা তেমনি বৈচিত্র রয়েছে সভাকর বাড়ির দুর্গা প্রতিমায়। সাবেকি আমলের একচালার কাঠামোয় দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। তবে এই সভাকর বাড়িতে দুর্গা প্রতিমায় সাধারণ রীতির ঠিক বিপরীত অবস্থান দেখা যায় গনেশ ও কার্তিকের। এই বাড়ির প্রতিমায় গনেশ দেবী দুর্গার ডানদিকে না থেকে বাম দিকে অবস্থান করেন। আর কার্তিক বামদিকের পরিবর্তে ডানদিকে অবস্থান করেন। তবে কলা বউকে দুর্গা প্রতিমার ডানদিকে অর্থাৎ কার্তিকের পাশে রেখেই পুজো হয়। লক্ষী ও সরস্বতীর অবস্থানে অবশ্য কোন পরিবর্তন নেই। এই বাড়ির প্রতিমায় দুর্গার বাহন সিংহ সাদা বর্ণের। তার মুখটি আবার ঘোড়ার মুখের ন্যায়। রায়নার মহেশ পালের পরিবার পুরুষানুক্রমে সভাকর বাড়ির এমন ব্যতিক্রমী মূর্তি তৈরি করে আসছেন।প্রতিমায় গনেশ ও কার্তিকের স্থান বদল প্রসঙ্গে দেবাশিষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, তাদের বংশের এক সাধক পূর্ব পুরুষ আকন্ঠ কারণ সুধা পান করে পুজো বসেছিলেন। পণ্ডিত মশাই তাঁকে দক্ষিণে গনেশায় নমঃ ও বামে কার্তিকেয় নমঃ বলে পুজো করতে বলেলেও তিনি ঠিক তার উল্টোটাই বলে চলেন। পণ্ডিত মশাই তাঁর প্রতিবাদ করলে সাধক পূর্ব পুরুষ পণ্ডিত মশাইকে চোখ মেলে প্রতিমার দিকে তাকাতে বলেন। তখন পণ্ডিত মশাই সহ পরিবারের অন্য সবাই প্রতিমার দিকে তাকিয়ে দেখেন সত্যি দেবী দুর্গার বামে গনেশ ও ডানদিকে কার্তিক রয়েছে। সেই থেকে বামে গণেশ ও ডানদিকে কার্তিককে অধিষ্ঠিত রেখেই সভাকর বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়ে আসছে। সাদিপুরের সভাকর বাড়ির গৃহকর্ত্রী মানসি চট্টোপাধায় জানান, প্রতিপদের দিন থেকেই চণ্ডীপাঠ, আরতি ও ভোগ বিতরণের মধ্যদিয়ে তাঁদের বাড়ির পুজোর বোধন শুরু হয়ে যায়। নিষ্ঠা ও ভক্তিকে সম্বল করে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যদিয়ে তন্ত্র মতে মায়ের পুজো হয়। স্থানীয় পূজারী মাণিক মুখোপাধ্যায় বলেন, পূর্বে বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দিরে কামান দাগার শব্দ শুনতে পাওয়ার পর সভাকর বাড়িতে মহাষ্টমির সন্ধি পুজোর বলিদান শুরু হত। সেই সব এখন ইতিহাস। বর্তমানে পঞ্জিকার সাময় সারণী ধরে বলিধান হয়। দশমির দিন দধিকর্মা বিতরণ ও সিঁদুর খেলা পর্ব মিটে যাওয়ার পর রাতে শোভাযাত্রা সহকারে দুর্গা প্রতিমা দামোদরে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করা হয়। থিম ভাবনা ও আলোক রোশনাইয়ের ঘনঘটা না থাকলেও ভক্তিভাব ও নিজস্ব স্বকীয়তাতেই সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজো বিশেষ মাধুর্য বহন করে চলেছে।